গৌতম সমাজদার এর গল্প মানবতা
অন্যবাংলায় আজকে প্রকাশিত হলো গৌতম সমাজদার এর মানবতা শিরোনামে ১ টি চমৎকার গল্প। আপনারা এই মানবতা গল্পটি পড়ুন ও আপনাদের মতামত জানান।
শিরোনাম – মানবতা
কলমে – গৌতম সমাজদার
মালতী কয়েকটা বাড়ির বাঁধা কাজের মাসী। স্বামী হারান পরের জমিতে খাটে। রোজ কাজও পায়না তাই মালতীর ওপর নির্ভর পাঁচটা পেট। মালতী এখন গর্ভবতী। ওর আগের বাচ্ছা টা পেটেই মরে গেছিল। মরাই জন্মেছিল। বেশীর ভাগ কাজের বাড়ি গুলো থেকেই বললো, মালতী ভালো জায়গায় দেখাও। সরকারী হাসপাতালে তো কিছুই হয়না। সবেতেই দায়সারা ভাব। ওদের মন বলেও কিছু নেই। শুধু বিশেষ ধরা করা থাকলে বা রাজনৈতিক দাদা-দিদি রা বললেই একমাত্র কাজ হয়। কিন্তু হারান বা মালতীর কারোরই ওসব জোড় নেই। আর অত পয়সা ই বা কোথায় বাইরে দেখানোর মত? ওদের সরকারী হাসপাতাল ই ভরসা। মালতী বরাবর ই খুব দুর্বল, অপুষ্টি জনিত অসুখে ভোগে। হিমোগ্লোবিন সব সময়েই স্বাভাবিকের থেকে নীচে থাকে।
গ্রাম থেকে তিন মহল দুরে ব্লক হাসপাতাল আর ৬০ কিমি দুরে জেলা হাসপাতাল। এই ব্লক হাসপাতালের একমাত্র MBBS ডাক্তার নিলয় মজুমদার। এই অজ গাঁয়ে কোনো ডাক্তার ই থাকতে চায়না। নিয়োগ পত্র নিয়ে আসে আর কয়েক মাসের মধ্যেই নেতা মন্ত্রী ধরে শহরের কাছাকাছি চলে যায়। নিলয় যে department এ prayer দেয়নি তা নয় তবে সেটার জন্য খুব বেশী তদ্বির ও করেনি কারন এই গরীব মানুষ গুলোর পাশে না থেকে ও থাকতে পারেনা। নিলয় ওর পরিবার নিয়ে কোয়ার্টারেই থাকে। ওর স্ত্রী মানালী ওর এই আদর্শ কে সম্মান করে। ছেলে অভীক গ্রামের একটা সাধারণ স্কুলেই পড়ে। এই বছর জয়েন্ট দেবে। ও একটু চুপচাপ শান্ত ধরনের ছেলে। শহুরে প্রভাব একদম ওর মধ্যে পড়েনি। নিলয় নিজের কাজ শেষে সময় পেলেই ছেলে কে পড়ায়।
সেদিন খুব রুগীর চাপ ছিল। কোনো এক মন্দিরে সিন্নি খেয়ে কাতারে কাতারে অসুস্থ লোক আসছিল। দু-একজন ছাড়া সবাই কে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আর ধকল নেওয়া যাচ্ছিল না, খুব ক্লান্ত লাগছিলো। সাহায্য করার জন্য একজন সিস্টার, একজন ফার্মাসিস্ট আর একটি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী। ক্লান্ত শরীর টাকে সোফায় এলিয়ে নিলয় বসলো। মানালি বললো, অনেক তো আত্মত্যাগ করলে। এবার একটু চেষ্টা করে দেখোনা যদি শহরের দিকে posting পাও। অভির তো এখানে এবছরই পড়া শেষ।
ঈষত ক্লান্ত গলায় বললো, তুমি তো জানো আমার তো নেতা-মন্ত্রী দের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই আর ওপরমহলেও তেমন catch নেই। আর থাকলেও কারোর হাতে পায়ে ধরে নিজের আত্ম-মর্যাদা জলাঞ্জলি দেবো না। আর এই মানুষ গুলোর কথা তো কেউ ভাবে না বলো? ওরা তো আমাকে প্রায় ভগবানের পরেই ভাবে। তেমন হলে অভীক কে নিয়ে তুমি কলকাতা চলে যাও। ওর ও তো career তৈরি করতে হবে! মানালি রাগ করে বললো, কি করে ভাবতে পারলে আমরা তোমাকে একা করে চলে যাবো? যাও যাও, হাত মুখ টা ধুয়ে খাবে এসো।
এই গ্রামে রাতে আলো থাকেনা। হাসপাতাল আর এই কোয়ার্টার জেনারেটরে চলে। তাই সন্ধ্যা হওয়ার আগেই লোকজন বাড়ি ঢুকে যায়। রাস্তাঘাট শুনশান। রাত ১১ টা নাগাদ মালতীর জল ভাঙ্গা শুরু হলো। অনেক কষ্ট করে মালতী কে পাঁজাকোলা করে হারান হাসপাতাল অবধি কোনোমতে আসে। খবর পেয়েই নিলয় সঙ্গে-সঙ্গে হাসপাতালে চলে আসে। মালতী কে দেখেই বুঝতে পারে খুবই রক্তাল্পতা আছে। সিস্টার কে বলে blood grouping টা করার জন্য। নিলয়ের নিজস্ব একটা blood grouping kit এনে দেয়। পরীক্ষা করে দেখা যায় A (-)ve. এদিকে মালতীর অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। এক্ষুনি রক্ত দেওয়া প্রয়োজন কিন্তু এই group এর রক্ত তো নেই কারন এটা rarest of the rare group।
জেলা হাসপাতালে হয়তো পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ওখানে রেফার করলে যেতে যেতেই রুগী মরে যাবে। খুবই তৎপরতার সঙ্গে হারানের grouping করা হয়। সিস্টার, ফার্মাসিষ্ট এমন কি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী টির ও grouping করা হল। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই হতাশই হতে হয়। হঠাৎ নিলয়ের মনে হলো আরে!! অভীকেরই তো ঐ একই group। ওর সবে আঠারো হয়েছে কিন্তু তিনদিন বাদেই পরীক্ষা! ওর মা জানতে পারলে কিছুতেই রাজী হবে না কিন্তু চোখের সামনে দুটো প্রাণ চলে যাবে? নিরূপায় হয়েই নিলয় ছেলেকে rest room এ ডাকলেন বললেন biology বই টা সঙ্গে নিয়ে আসতে। মা কে বলে অভীক সঙ্গে সঙ্গেই চলে এলো।
rest room এ বসেই অভীক ছেলের মাথায় হাত দিয়ে গভীর স্বরে বললেন, তোকে আজ একটা বড় কাজ করতে হবে। একজনের জীবন বাঁচাতে হবে-বলেই সিস্টার কে blood নেওয়ার arrangement করতে বললেন। অভীক ও কিছু বোঝার আগেই শুয়ে পড়লো রক্ত দেওয়ার জন্য। বাবার এই টুকু ইচ্ছের দাম দেবে না, তাই কি হয় নাকি? রক্ত পাওয়া গেল এবং যথেষ্ট ঝুঁকি নিয়েই রক্ত চালানোও হলো। মালতীর অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হলো। নিলয় অভীক কে বললো, ঘরে গিয়ে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিবি।
অভীক ফিরেই দুধ টা খেয়ে ঘুমোতে চলে গেল, মা কে বললো বাবা পড়ালো আর বাবার ফিরতে একটু দেরী হবে। এদিকে মালতী যেহেতু negative group এর mother তাই ওকে একটা injection ও দিতে হলো। রাত প্রায় তিনটে নাগাদ মালতী নির্বিঘ্নে একটি সন্তান প্রসব করে। হারান হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আপনি ডাক্তার ভগবান। এখনও এমন ভগবান আছেন বলে আমরা এই গরীব গুলো বেঁচে আছি। পরজন্মেও আপনি যেন এমন ভগবান হয়েই জন্মান আমাদের জন্য। এই দরদী মন নিয়েই আমাদের উদ্ধার করবেন।