ইসলামে মৃত্যুর পর একজন মুসলমানের প্রতি শেষ দায়িত্বগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তার জানাজায় অংশগ্রহণ করা এবং দোয়া করা। একজন মুমিনের জীবনের শেষ বিদায়ে এই জানাজা নামাজের মাধ্যমে আমরা তার জন্য আল্লাহর কাছে রহমত, ক্ষমা ও জান্নাত প্রার্থনা করি। তাই জানাজার নামাজের দোয়া শেখা ও বোঝা কেবল ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি আমাদের ঈমানের অংশ এবং সমাজের প্রতি দায়িত্বও বটে।
জানাজার নামাজ সাধারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মতো নয়। এতে রুকু বা সিজদা থাকে না, বরং নির্দিষ্ট তাকবির, দরুদ এবং দোয়ার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করা এবং আল্লাহর কাছে তার জন্য মাফ প্রার্থনা করা। একজন মুসলমান হিসেবে এই দোয়া জানা থাকলে তুমি কেবল নিজের কর্তব্যই পূরণ করবে না, বরং মৃত ব্যক্তির জন্য বিশাল সওয়াব অর্জন করার সুযোগ পাবে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—এই নামাজ ও দোয়া শুধুমাত্র মৃত ব্যক্তির জন্য নয়, জীবিতদের জন্যও শিক্ষা। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে একদিন আমরাও পৃথিবী ত্যাগ করবো এবং তখন অন্যরা আমাদের জন্য একইভাবে দোয়া করবে।
জানাজার নামাজ – সংজ্ঞা ও গুরুত্ব
ইসলামী শরিয়তে জানাজার নামাজকে ফরজে কেফায়া বলা হয়েছে। অর্থাৎ, মুসলিম সমাজের কেউ যদি এই নামাজ আদায় করে, তাহলে বাকিদের ওপর দায়িত্ব উঠে যায়, কিন্তু কেউ না করলে পুরো সমাজ পাপের ভাগীদার হয়। এই নামাজ মৃত মুসলিম ভাই-বোনের প্রতি আমাদের শেষ বিদায় এবং দায়িত্ব পালন করার এক মহান মাধ্যম। এটি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং আত্মার জন্য দোয়া, রহমত কামনা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার এক বিশেষ সুযোগ।
জানাজার নামাজের দোয়া মূলত সেই কেন্দ্রবিন্দু যা এই নামাজকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে। নামাজে রুকু, সিজদা বা কিয়াম নেই; বরং তাকবির, দরুদ এবং দোয়ার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন করা হয়। এর প্রতিটি অংশে মৃত ব্যক্তির জন্য কল্যাণ কামনা এবং আল্লাহর কাছে জান্নাত প্রার্থনা করা হয়। এটি এমন এক ইবাদত, যেখানে তোমার আন্তরিকতা এবং মনোযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এই নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা এসেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জানাজায় অংশ নেয় তার জন্য একটি কিরাত সওয়াব রয়েছে, আর যে ব্যক্তি দাফন পর্যন্ত সাথে থাকে তার জন্য দুটি কিরাত।” সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, কিরাত বলতে কী বোঝানো হয়েছে? তিনি বললেন, “উহুদ পর্বতের সমান সওয়াব।” (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস থেকেই বোঝা যায়, জানাজায় অংশ নেওয়া এবং দোয়া পড়া কতটা সওয়াবের কাজ।
জানাজার নামাজের নিয়ম ও ধাপসমূহ
জানাজার নামাজ মুসলমানদের জন্য এক বিশেষ ইবাদত, যা সাধারণ সালাতের তুলনায় আলাদা রূপে আদায় করা হয়। এতে রুকু, সিজদা, কিয়াম বা কিরাত নেই; বরং চারটি তাকবির এবং নির্দিষ্ট দোয়ার মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হয়। নিচে ধাপে ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি সহজভাবে তুলে ধরা হলো, যাতে তুমি সঠিকভাবে নামাজটি আদায় করতে পারো।
নামাজের প্রস্তুতি
জানাজার নামাজের আগে কিছু শর্ত পূরণ করা জরুরি। প্রথমত, নামাজ আদায়কারীর ওযু থাকতে হবে এবং শারীরিকভাবে পবিত্র থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, কিবলাহ মুখ করে দাঁড়াতে হবে এবং নিয়ত পরিষ্কারভাবে করতে হবে।
প্রথম তাকবির ও সানা
ইমাম “আল্লাহু আকবার” বলে প্রথম তাকবির বলবেন এবং হাত কান পর্যন্ত তুলে বুকে ভাঁজ করবেন। এরপর সাধারণ নামাজের মতো “সানা” বা “সুবহানাকাল্লাহুম্মা…” দোয়া পড়া হবে।
দ্বিতীয় তাকবির ও দরুদ
দ্বিতীয় তাকবিরের পর হাত না তুলে বুকে রেখে নবী করিম (সা.)-এর উপর দরুদ পাঠ করতে হবে, যেমন আমরা তাশাহহুদের পর সালাতুল ইবরাহিমিয়া পড়ি।
তৃতীয় তাকবির ও দোয়া
এটি জানাজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তৃতীয় তাকবিরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা হয়। এটি হতে পারে সংক্ষিপ্ত বা পূর্ণ দোয়া, কিন্তু আন্তরিকতা সহকারে পড়া অত্যাবশ্যক।
চতুর্থ তাকবির ও সালাম
চতুর্থ তাকবির বলার পর ইমাম ও মুসল্লিরা ডান ও বামে সালাম দিয়ে নামাজ শেষ করেন।
বিশেষ অবস্থায় পার্থক্য
শিশু বা নবজাতকের জানাজায় দোয়ায় সামান্য পার্থক্য থাকে, সাধারণত তাদের জন্য ক্ষমার বদলে জান্নাতে স্থান প্রার্থনা করা হয়।
এই ধাপগুলো মনোযোগ দিয়ে অনুসরণ করলে জানাজার নামাজ সঠিকভাবে আদায় করা সম্ভব। এটি কেবল একটি রীতি নয়, বরং মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য তোমার পক্ষ থেকে সর্বোত্তম উপহার।
জানাজার নামাজের দোয়া — আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
জানাজার নামাজের মূল ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো দোয়া। এটি এমন একটি ইবাদত যা মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য রহমত, ক্ষমা ও জান্নাত প্রার্থনার সুযোগ করে দেয়। নিচে তোমার জন্য দোয়ার আরবি পাঠ, বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যাতে তুমি সহজেই তা মুখস্থ করতে পারো এবং সঠিকভাবে আদায় করতে পারো।
জানাজার নামাজের দোয়া (আরবি)
اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ وَارْحَمْهُ وَعَافِهِ وَاعْفُ عَنْهُ، وَأَكْرِمْ نُزُلَهُ، وَوَسِّعْ مُدْخَلَهُ، وَاغْسِلْهُ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ، وَنَقِّهِ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، وَأَبْدِلْهُ دَارًا خَيْرًا مِنْ دَارِهِ، وَأَهْلًا خَيْرًا مِنْ أَهْلِهِ، وَزَوْجًا خَيْرًا مِنْ زَوْجِهِ، وَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ، وَأَعِذْهُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَعَذَابِ النَّارِ
বাংলা উচ্চারণ
আল্লাহুম্মাগফির লাহু, ওয়ারহামহু, ওয়া’আফিহি, ওয়া’ফু আনহু।
ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি’ মুদখালাহু।
ওয়াগসিলহু বিলমা-ই ওয়াস্সালজি ওয়ালবারাদি।
ওয়া নাক্কিহি মিনাল খাতায়া কামা ইউনাক্কাস্-সাওবুল আবইয়াদু মিনাদ-দানাস।
ওয়া আবদিলহু দারান খাইরান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি, ওয়া জাওজান খাইরান মিন জাওজিহি।
ওয়া আদখিলহুল জান্নাহ, ওয়া আ’ইযহু মিন আযাবিল কবরি ওয়া আযাবিন্নার।
বাংলা অর্থ
“হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন, তার প্রতি দয়া করুন, তাকে নিরাপদ রাখুন এবং ক্ষমা করে দিন।
তার অতিথেয়তা সম্মানজনক করুন, তার কবর প্রশস্ত করুন।
তাকে পানি, বরফ ও শিলাবৃষ্টি দিয়ে পবিত্র করুন এবং তার পাপগুলোকে দূর করুন যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পবিত্র হয়।
তাকে তার ঘরের চেয়ে উত্তম একটি ঘর দিন, তার পরিবার ও সঙ্গীর চেয়ে উত্তম পরিবার ও সঙ্গী দিন।
তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান এবং তাকে কবরের শাস্তি ও জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।”
এই দোয়াটি নবী করিম (সা.) নিজেই জানাজার সময় পড়তেন এবং সাহাবায়ে কিরামদেরও তা শিখিয়েছেন। তুমি চাইলে এর সংক্ষিপ্ত রূপও পড়তে পারো, তবে সম্পূর্ণ দোয়াটি পড়াই উত্তম। মনে রাখবে, এই জানাজার নামাজের দোয়া কেবল শব্দের সমষ্টি নয়; এটি মৃত আত্মার জন্য তোমার পক্ষ থেকে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন: জানাজার নামাজের দোয়া কত প্রকার?
উত্তর: জানাজার নামাজে মূলত একটি দোয়াই পড়া হয়, যা নবী করিম (সা.) থেকে প্রমাণিত। তবে এর সংক্ষিপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ উভয় রূপ রয়েছে। নবীজী (সা.) বিভিন্ন সময়ে সংক্ষিপ্ত ও দীর্ঘ দোয়া উভয়ই পড়েছেন।
প্রশ্ন: শিশু বা নবজাতকের জানাজায় কোন দোয়া পড়া হয়?
উত্তর: শিশু বা নবজাতকের জানাজায় সাধারণত ক্ষমার বদলে জান্নাতের প্রার্থনা করা হয়। কারণ তারা পাপমুক্ত অবস্থায় মারা যায়। তাই “اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ فَرَطًا” (হে আল্লাহ! তাকে জান্নাতে আমাদের জন্য অগ্রদূত করে দিন) ইত্যাদি দোয়া পড়া উত্তম।
প্রশ্ন: যদি জানাজার দোয়া ভুল হয়ে যায় তাহলে কী হবে?
উত্তর: যদি উচ্চারণে সামান্য ভুল হয় কিন্তু অর্থ বিকৃত না হয়, তাহলে নামাজ বাতিল হয় না। তবে দোয়া ভুলে গেলে সংক্ষিপ্ত দোয়া যেমন “আল্লাহুম্মাগফির লাহু” (হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করুন) পড়লেও নামাজ বৈধ হয়।
প্রশ্ন: আরবি না জানলে কি বাংলা ভাষায় দোয়া পড়া যাবে?
উত্তর: আসল দোয়া আরবিতেই পড়া উত্তম, কারণ এটি নবী করিম (সা.) থেকে প্রমাণিত। তবে যদি কেউ নতুন মুসলিম হয় বা এখনো আরবি শিখে না থাকে, সে মন থেকে নিজের ভাষায় দোয়া করতে পারে।
প্রশ্ন: জানাজার নামাজে কয়বার হাত উঠানো হয়?
উত্তর: জানাজার নামাজে মোট চারটি তাকবির হয়। প্রথম তাকবিরের সময় হাত উঠানো সুন্নত, তবে বাকি তিন তাকবিরে হাত না তোলাই উত্তম।
সমাপনী অংশ
জীবনের অনিবার্য সত্য হলো মৃত্যু। একজন মুসলমান হিসেবে মৃত্যুর পর আমরা একে অপরের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করি, তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জানাজার নামাজ এবং দোয়া। এই নামাজের মাধ্যমে আমরা কেবল মৃত ব্যক্তির আত্মার জন্য রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করি না, বরং নিজের আখিরাত সম্পর্কেও স্মরণ করি এবং আত্মসমালোচনার সুযোগ পাই। তাই জানাজার নামাজের দোয়া শেখা, বুঝে পড়া এবং মন থেকে দোয়া করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
এটি শুধু একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং সমাজিক বন্ধন ও ঈমানের পরিচয়। জানাজায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ একত্রিত হয়, একে অপরের প্রতি দায়িত্ব পালন করে এবং মৃত ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী।
তুমি যদি জানাজার নামাজের নিয়ম, দোয়া এবং এর তাৎপর্য ভালোভাবে জেনে রাখো, তাহলে তা শুধু মৃত আত্মার জন্যই নয়, তোমার নিজের ঈমানি জীবনের জন্যও বিশাল কল্যাণ বয়ে আনবে।