ধারাবাহিক গল্প মামলাণু শেষ পর্ব
অন্যবাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে রাজিত বন্দোপাধ্যায় এর ধারাবাহিক গল্প মামলাণু। আজ থাকছে এই ধারাবাহিক গল্প মামলাণু শেষ পর্ব। আপনার এই ধারাবাহিক গল্পটি পড়ুন ও আপনাদের মতামত জানান।
আগের পর্ব গুলো ধারাবাহিক গল্প মামলাণু (১ম পর্ব) ধারাবাহিক গল্প মামলাণু ২য় পর্ব
মামলাণু শেষ পর্ব রাজিত বন্দোপাধ্যায়
আমি টুকরোটা নিজের মানি ব্যাগে চালান করে দিলাম । আর কিছু নেই দেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখি চা হাজির ।
ক্রীক রো থেকে বেরিয়ে আমরা মেসে ফিরে এলাম বারোটা নাগাদ । দুপুরে খাবার পর আমি মেসের অফিসের টেবিলে রাখা ডাইরেক্টরিটি ঘাটা শুরু করলাম ।
অনিমেষ ভড় আড় চোখে দেখে বললেন ,
— কার নম্বর খুঁজছেন মশাই !
— হ্যামিলটন ফিনান্স ।
— নিরুদ্দেশ ব্যক্তির অফিসের ?
— হুম ! এই তো পেয়েছি ।
আমি মেসের ফোন থেকে নম্বরটা ডায়েল করলাম । ওপাশে বেজেই যাচ্ছে ! হঠাৎ বাজনা থামল । কেউ মোটা স্বরে বললেন ,
— হ্যালো ?
— এটা কি হ্যামিলটন ফিনান্স ?
— নিশ্চই । কাকে চাই ?
— নমস্কার , আমি একজনের সম্পর্কে কিছু জানতে চাই । আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর । নাম জিৎ ব্যানার্জি ।
— নাম বলুন ।
— কৌশিক চ্যাটার্জি ।
— এ নামে তো এখানে কেউ নেই ।
— আজ্ঞে সেটা আমিও জানি , তবে দশ বছর আগে ছিলেন ।
— তবে তো ম্যানেজারই বলতে পারবেন । আপনি পাঁচটা নাগাদ এলে দেখা পাবেন ।
— এ্যাপয়েন্টমেন্ট টা একটু ফিক্স করে দেবেন প্লীজ ?
— তা দিচ্ছি ।
ওপাশের স্বর স্তব্ধ হল ও ফোনের কানেকশন কেটে গেল । অনিমেষ ভড় আমায় বললেন ,
— তাহলে তো চারটেয় বেরুতে হয় মশাই ।
— নিশ্চই ।
পাঁচটায় হ্যামিলটন ফিনান্সের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে জানা গেল , কৌশিক চ্যাটার্জি ওদের একজন একজিকিউটিভ অফিসার ছিলেন । গত দশ বছর আগে কোম্পানীর টাকা কড়ির ব্যাপারে একটা গোলমাল হয় । সেই সময় একজন ডিরেক্টর তাঁর নিজের বাড়িতে খুন হয়ে যান । তাঁর মোবাইলের যোগাযোগ বিশ্লেষণে দেখা যায় বিকেলের দিকে কৌশিক চ্যাটার্জির সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন । পুলিশ এনকোয়ারী হয় । বার দুই কৌশিক চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল । তারপর তদন্ত চলাকালীন হঠাৎই সে উধাও হয়ে যায় । অবশ্যি পুলিশও আর তাঁর খোঁজ করেনি । ম্যানেজার রবার্ট ডিসুজা বললেন ,
— এই টুকুই শুধু আমি জানি । কোম্পানীর হাত বদল হবার পর আমি জয়েন করি মিঃ ব্যানার্জি । আপনি বরং আমাদের হেডক্লার্ক কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন ।
অগত্যা আমি আর ভড় মশাই গিয়ে ধরলাম হেডক্লার্ক কে । হেডক্লার্ক বেশ বয়স্ক মানুষ । নাম অনন্ত চৌধুরী । বেশ সভ্রান্ত চেহারার মানুষ । তিনিও যা বললেন তা ম্যানেজারের চেয়ে কিছু বেশি না । কেবল একটা লাইন বেশি পাওয়া গেল তাঁর মুখ থেকে যে , কাবেরী মুখোপাধ্যায় নামে তাদের এক মহিলা এজেন্টের সঙ্গে কৌশিকের খুব জমতো । সে হয়ত কিছু জানতে পারে । কাবেরী মুখোপাধ্যায়ের ঠিকানা জানতে চাইলে , তিনি তাঁর একজন দপ্তরীকে দিয়ে একটা মোটা পুরানো জাব্দা খাতা আনিয়ে ঠিকানাটা দিলেন । ২৪ , পরীক্ষিত রায় লেন । কাবেরীও প্রায় দশ বছর হল কাজ ছেড়ে দিয়েছেন ।
পরীক্ষিত লেনের বাড়িটা একটা ঢাউস ভাড়া দেওয়ার বাড়ি । খোপে খোপে ভাড়াটে । আমরা কেয়ার টেকারের কাছে জানলাম , কাবেরী মুখোপাধ্যায়ের বাবা দশ বছর আগে তাঁর মেয়ের হঠাৎ উধাও হয়ে যাবার কয়েক মাস পরেই মারা যান । তাঁর স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিলেন । ভদ্রলোকের নিজের কেউ ছিল না । তাঁর শালা নিকুঞ্জ সান্যাল থাকেন ছকু খানসামা লেনে । শেয়ালদার উত্তরে । সেই এ বাড়ির ভাড়ার বকেয়া টাকাটা দিয়ে জিনিসপত্র সব নিয়ে যান ।
— ভদ্রলোকের ঠিকানাটা ?
— ২৭ , ছকু খানসামা লেন , শেয়ালদা ।
সেখান থেকে বেরোতেই অনিমেষ ভড় বলে উঠলেন ,
— উরিব্বাস ! এ তো মশয় জোড়া নিরুদ্দেশের কেস হয়ে গেল ।
আমি নিস্পৃহ কন্ঠে বললাম ,
— এখনো জোড়ে কিনা তার কোন প্রমাণ হাতে নেই ।
অনিমেষ ভড় বললেন ,
— হতেও তো পারে ।
আমি কথা না বলে হাঁটতে লাগলাম । ছকু খানসামা লেনে ঢুকে বাড়িটা খুঁজে পেতে দেরী হল না । কাবেরী মুখোপাধ্যায়ের মামা আমাদের সাদরে তাঁর বৈঠকখানা ঘরে বসালেন । ভদ্রলোকের পয়সা এবং রুচি দুটোই এ ঘরে বর্তমান । আমার প্রশ্নে প্রথমে বিস্ময় ও পরে ক্ষোভ জানালেন । কাবেরীর জিনিসপত্রের কথা জিজ্ঞেস করতে তিনি জানালেন , ওর মামী সযত্নে প্যাক করে রেখে দিয়েছে । এমন সময় দু কাপ চা হাতে নিয়ে ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন । আমাদের দুজনের হাতে চা ধরিয়ে দিয়ে বললেন ,
— থাকার মধ্যে কিছু বইপত্র । বাকী জিনিস পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গিয়েছে ।
তা শেষ করতে পাশের একটা ছোট্ট ঘর খুলে আমাদের দেখালেন । বইপত্তরের মধ্যে একটা হ্যামিলটনের ডাইরি দেখে সেটা তুলে নিলাম । হিসেবের ফাঁকে ফাঁকে কিছু ব্যক্তিগত কথা লেখা আছে দেখে আমি বললাম ,
— এটা আমি নিতে পারি ?
ভদ্রলোক দুঃখ ভরা স্বরে বললেন ,
— নিশ্চই । এ আর কার কাজে লাগছে !
কাবেরীর মামার বাড়ি থেকে বেরিয়েই ভড় মশাই যে জিনিসটা আমার হাতের তালুতে গুঁজে দিলেন , তা হল গিয়ে একটা লালচে পেপার কাটিং – এর বিজ্ঞাপন ! তাতে লেখাঃ An English teacher require for a private Primary school , apply Post Box No. – 103 , Srinagar , Pouri – Garwal , Uttarakhand .
— এটা আপনি কোথায় পেলেন ?
— পেন , পেন্সিল রাখবার টাম্বলারের ভিতরে ছিল ।
— মনে হচ্ছে আপনার অনুমানই ঠিক । তবু একবার থানাটায় ঘুরে আসছি । আপনার আর সময় নষ্ট করবো না । আপনি বরং মেসে ফিরে যান ।
আমি থানায় গিয়ে দেখি , আমার পরিচিত বন্ধু পরিতোষ মল্লিক বসে । তাঁর চেষ্টায় জানতে পারা গেল যে , ঐ ডিরেক্টারের মৃত্যুতে বার দুই পুলিশের পাল্লায় পড়ায় কৌশিক বোধকরি সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল । তাকে পরে দরকার হতে পারে বলে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আসল খুনী ধরা পড়ায় আর কাউকে জেরা করা হয়নি । কেস খতম হয়ে গিয়েছিল পরের বছরই ।
অনিমেষ ভড় আর আমার সঙ্গে শ্রীনগর ধাওয়া করতে পারেননি । শ্রীনগরে ওদের দুজনকে আমি সহজেই খুঁজে পাই । তাছাড়া ওরাও নিশ্চিন্তে বিবাহিত জীবন যাপন করছিল ।
বলা বাহুল্য যে , হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় আমাকে আরো একটা দশ হাজারের চেক দিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র নাতনীর হাত দিয়ে । তবে সবচেয়ে যেটা অবাক করা বিষয় ছিল তাহল কাবেরীর মামাও আমায় তাঁর ভাগ্নী কে খুঁজে বের করানোর জন্য একটা পাঁচ হাজারের চেক দেওয়া ! কেবল কাবেরী দুঃখ প্রকাশ করলে তার বাবার মৃত্যুর সময় সে উপস্থিত থাকতে পারেনি বলে । কিন্তু ওর বাবা জানতেন ও উধাও নয় , কৌশিকের সঙ্গে চলে গিয়েছে !!
আরো পড়ুন হারানোর পথে পাখির কলকাকলি ছোট গল্প: মায়ের চিঠি দেশলাইয়ের বাক্স ধারাবাহিক গল্প মামলাণু (১ম পর্ব) ধারাবাহিক গল্প মামলাণু ২য় পর্ব
আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত হন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হন আমাদের ফেসবুক পেজ এ যুক্ত হন