ভিনদেশি বিবাহ

ভিনদেশি বিবাহ
শংকর ব্রহ্ম

অন্যবাংলায় আজকে প্রকাশিত হলো শংকর ব্রহ্ম এর “ভিনদেশি বিবাহ” শিরোনামে ১ টি চমৎকার নিবন্ধ। আপনারা এই ভিনদেশি বিবাহ নিবন্ধটি পড়ুন ও আপনাদের মতামত জানান।

প্রেমের টানে সাত সাগর আর তেরো নদী পাড়ি দেওয়ার কাহিনি নতুন নয়। অনেক ভিনদেশী তরুণী বাঙালী যুবককে বিয়ে করে কেউ সংসার করছেন, কেউ ফিরে গেছেন। এমন কিছু ঘটনা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ফেসবুকে ও সংবাদমাধ্যমে। তারই কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরা হল।

(১).

লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের খাদিজা-ইকবাল দম্পতির কথা।
ভালোবাসার টানে কয়েক দিন আগে ইতালি থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন এক তরুণী। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে বিয়ে করেন ইকবাল হোসেনকে। বিয়ের সময় ইতালীয় এই তরুণীর নতুন নাম রাখা হয় খাদিজা আক্তার। তার পরপরই মধুচন্দ্রিমা উপভোগ করতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন এই নবদম্পতি। পুত্রবধূকে সানন্দে গ্রহণ করে নিয়েছে ইকবালের পরিবার। ইকবালের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, ‘আমরা আনন্দিত। ছেলে-পুত্রবধূর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।’ তিনি জানান, ভাষাগত কিছু সমস্যা থাকলেও পুত্রবধূ সবকিছুই মানিয়ে নিচ্ছেন, পরছেন বাঙালি পোশাকও।
২০১৫ সাল থেকে ১৭টির মতো এমন ঘটনার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেউ আছেন সুখে, আবার কেউ বা পালিয়ে। অনেকে প্রতারিত হয়েছেন। অনেক দম্পতি সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন।

(২).

পাঁচ বছর হলো বিয়ে করেছেন বাংলাদেশের আশিকুর রহমান ও মালয়েশিয়ার কলেজছাত্রী ফাতেমা বিনতে আবদুর রহমান।
কাজের সন্ধানে ২০১১ সালে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান আশিকুর। বছর দুয়েক পর সেখানে পরিচয় ঘটে ফাতেমার সঙ্গে। আশিকুর ২০১৫ সালে দেশে আসেন। এরপর তাঁর মালয়েশিয়া ফিরতে দেরি হচ্ছিল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় ফাতেমার। প্রেমিকের টানে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী মাহবুব হাসানের চেম্বারে বিয়ে করেন দুজন। আশিকুরের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার মন্দিবাগে। বিয়ের পর স্ত্রীকে বাড়িতেও নিয়ে গেছেন আশিকুর। বর্তমানে দুজনেই মালয়েশিয়ায় থাকেন। দুই সন্তান তাঁদের।সুখে আছেন।

(৩).

এলিজাবেথ আর মিঠুনও সুখে আছেন। মিঠুন বিশ্বাসের সঙ্গে ২০১৫ সাল থেকে ফেসবুকে প্রেম হয় মার্কিন তরুণী এলিজাবেথের।
২০১৭ সালের ২রা জানুয়ারি প্রেমের টানে চলে আসেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহের এক গ্রামে। ৯ই জানুয়ারি এলিজাবেথ বিয়ে করেন মিঠুন বিশ্বাসকে। ভালো চলছে তাঁদের সংসার জীবন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুজনে সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন বসবাস ভার্জিনিয়া শহরে। দুজেনেই দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন বলে জানিয়েছেন মিঠুনের ভাই পলাশ বিশ্বাস।

See also  ধারাবাহিক গল্প মামলাণু (১ম পর্ব)

(৪).

ভেঙে গেছে সাহেদ ও লুসির সম্পর্ক।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্রাজিলের লুসি ক্যালেন ও বাংলাদেশের সাহেদ আহমেদের প্রণয়ের শুরু। ভালোবাসার টান অনুভব করে ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন লুসি। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ধর্মান্তরিত হয়ে সাহেদকে বিয়ে করেন।
বিয়ের কিছুদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে ব্রাজিলে পাড়ি জমান সাহেদ, কিন্তু সেখানে গিয়ে ভিন্ন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। জানতে পারেন, এর আগেও স্ত্রী লুসির বিয়ে হয়েছিল। এমনকি সন্তানও রয়েছে তাঁর। সাহেদ বুঝতে পারেন, তিনি চরমভাবে প্রতারিত হয়েছেন। লুসির সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টানেন তিনি।

(৫).

প্রেম এখনও অটুট থাইকন্যা সুপুত্তোর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় নওগাঁর ছেলে অনিক খানের। অনিকের সরলতা দেখে প্রেমে পড়ে যান সুপুত্তো। অবশেষে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরিবারের অনুমতি নিয়ে মাত্র পাঁচ দিনের জন্য বাংলাদেশে আসেন তিনি। অনিকের পরিবারের কাছে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। তবে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি তখন। শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হয় তাঁকে। মাস তিনেক পর আবার বাংলাদেশে ছুটে আসেন সুপুত্তো। এ যাত্রায় অনিকের পরিবারের সম্মতি পেয়ে যান তিনি। মুসলমান হলেন, নাম পাল্টে রাখলেন সুফিয়া খাতুন। নাটোরের আদালতে বিয়ে হলো।
সুফিয়া এখন থাকেন থাইল্যান্ডেই।ফাস্ট ফুডের ব্যবসা করেন। এদিকে নওগাঁয় অনিক ইলেকট্রনিকস পণ্যের একটি দোকান চালান। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন সুফিয়া।
বছরে বার দুয়েক নওগাঁ আসেন।

(৬).

ফিরে গেছেন জুলিজ। প্রেমের কারণে মালয়েশিয়া ছেড়ে টাঙ্গাইলের সখীপুরের মনিরুল ইসলামের কাছে ছুটে এসেছিলেন জুলিজা বিনতে কামিস। ফেসবুকে প্রেমের সূচনা। ২০১৭ সালে বিয়ে হয় তাঁদের। তবে মনিরুলের কপালে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বিয়ের সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে জানতে পারেন, মালয়েশিয়ায় জুলিজার আরও একটি সংসার রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, মালয়েশীয় তরুণী জুলিজার আগের স্বামীও একজন বাংলাদেশি। মনিরুল ও জুলিজার বিয়ের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এলে সেটি নজরে আসে জুলিজার প্রথম স্বামী আজগরের। এরপর আজগর ও তাঁর পরিবার মনিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মনিরুল জানতে পারেন, মালয়েশিয়ায় জুলিজার স্বামী ও চার সন্তানের সংসার। বাংলাদেশে আসার ১৭ দিনের মাথায় প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যান জুলিজা।

See also  সাপ্তাহিক কবিতা সমগ্র ২

(৭).

একত্রে বাস রুবেল আর এভিলার জীবিকার তাগিদে সিঙ্গাপুরে প্রবাসজীবন শুরু করেন কুড়িগ্রামের ছেলে রুবেল। চাকরি নেন কাচের কারখানায়। একই কারখানায় রুবেলের মতোই প্রবাসী শ্রমিক ছিলেন ফিলিপাইনের ফ্লোডিলিজ এভিলা টপিয়া। এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই ভালোবাসার ফানুস ওড়ান দুজনে। তবে ভালোবাসার আকাশে কালো মেঘের ছায়া দেখা দেয় রুবেলের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে এলে। ২০১৭ সালে বাধ্য হয়ে দেশে ফেরেন রুবেল। তবে ফেসবুক আর মুঠোফোনে যোগাযোগ চলতে থাকে তাঁদের।এ’ভাবেই কেটে যায় এক বছর। অবশেষে দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেন, বিয়েটা করেই ফেলবেন। ২০১৮ সালের মার্চে ঢাকায় আসেন এভিলা। ২৫ মার্চ ঢাকায় বিয়ে করেন এই যুগল। বিয়ের পর বউকে নিয়ে কুড়িগ্রামে যান রুবেল। বর্তমানে রুবেল ও এভিলা থাকেন সিঙ্গাপুরে।

(৮).

সঞ্জনা ও লাবু মিয়া ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৮ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার জামালপুর সীমান্তে বিজিবি আর বিএসএফের এক পতাকা বৈঠক বসে। উদ্দেশ্য ভারত থেকে চলে আসা সঞ্জনা বিশ্বাসকে ফিরিয়ে নেওয়া। ভারতের মেঘনা নদী দুটি দেশকে আলাদা করলেও ভারতের সঞ্জনা আর বাংলাদেশের লাবু মিয়াকে একই সুতোয় বেঁধেছে। কারণ, এই নদী পেরিয়েই ১৩ই সেপ্টেম্বর ভারতের চর মেঘনা থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন সঞ্জনা বিশ্বাস। এরপর প্রেমিক লাবু মিয়ার বাড়িতে ওঠেন তিনি। এদিকে সঞ্জনাকে খুঁজতে এসে বিএসএফ আর বিজিবির মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান চলে। তবে এরই মধ্যে বিয়ে করে ফেলেন এই প্রেমিক যুগল। বিয়ে করেই আত্মগোপনে চলে যান তাঁরা। সর্বশেষ লাবু মিয়ার পরিবার জানায়, তাঁরা দুজন একসঙ্গেই আছেন। তবে কোথায় আছেন তারা তার কোস ঠিকানা জানাননি।

বর্তমানে ইন্টারনেটের কারণে এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। আগেও হতো না এমন নয়। অনেক আগেই দেখেছি,রবীন্দ্রনাথের বড়দা এক বিদেশীনিকে বিয়ে করেছিলেন, কবি মধুসূদন দত্ত বিদেশিনীকে বিয়ে করেছিলেন।

কলকাতার পঞ্চাশ দশকের কবি প্রণবেন্দু
দাশগুপ্ত করে ছিলেন ম্যারিয়নকে (আমোরিকান),
কবি দীপক মজুমদার করেছিলেন ক্যারলকে (ইতালিয়ান।

See also  সাপ্তাহিক কবিতা সমগ্র ১

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে মূলত ভিনদেশি মেয়েদের সম্পর্ক গড়তে দেখা যায়। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, উন্নত দেশগুলোর ধারণা, এই অঞ্চলের পুরুষেরা বিশ্বস্ত হন। জীবনসঙ্গী হিসেবেও দক্ষিণ এশীয় পুরুষেরা তাঁদের দেশের পুরুষদের তুলনায় যোগ্য হন। তাই এই আকর্ষণ।এ’ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোতে পারিবারিক বিচ্ছেদের ঘটনা হামেশাই লেগে রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতে পারিবারিক বন্ধন আজও বেশ দৃঢ়। তাই এখানকার ছেলেদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চান তারা।

অন্যদিকে এই অঞ্চলের পুরুষদের ধারণা,থাই, ফিলিপিনো কিংবা জাপানি মেয়েরা বেশ স্বামীভক্ত হন। তাই এসব দেশের নারীদের সঙ্গে ঘর বাঁধতে চান এই অঞ্চলের পুরুষেরা। তা’ছাড়া উন্নত দেশে নাগরিকত্বের আশায় ভিনদেশি কাউকে বিয়ের ঘটনা তো এ’দেশে নতুন নয়। শুধু নাগরিকত্ব কিংবা উন্নত জীবনযাপনের সুযোগের আশায় অনেকে কাগজ-কলমেও বিয়ে করে থাকেন। এই ধরনের বিয়েগুলো থেকেই পরবর্তী সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনাগুলো ঘটতে দেখা যায়।
———————————-——————————–


তথ্যসূত্র সহায়তায় : –

শাহাদত হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া
আজাদ রহমান, ঝিনাইদহ
ওমর ফারুক, নওগাঁ
ইকবাল গফুর, সখীপুর (টাঙ্গাইল)
সফি খান, কুড়িগ্রাম
হাফিজুর রহমান, হবিগঞ্জ
এ বি এম রিপন, রায়পুর (লক্ষ্মীপুর)